ঠাকুরগাঁও শহরের কোটচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন লিটন। মোঃ মজিবর রহমান শেখ, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি, জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন ব্যথায় কাতরাচ্ছেন কলেজছাত্র লিটন। তার মাথায় পনেরোটি ও পুরো শরীরে আরও প্রায় সাড়ে চার শতাধিক গুলির আঘাত রয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উন্নত চিকিৎসায় যদি শরীর থেকে গুলিগুলো বের করা যায়, তবে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। তবে তার চিকিৎসা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
সম্প্রতি, গত চার আগস্ট, ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্ট চত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন লিটন। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা পৌরশহরের দক্ষিণ সালান্দর পাড়ার মিলন নগর মহল্লার বাসিন্দা এবং ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবার অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে লিটন খণ্ডকালীন চাকরি করতেন একটি ওষুধ ফার্মেসিতে। এখন সে চাকরিটাও আর নেই। তার বৃদ্ধ বাবার পক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসা কোনোভাবে করানো সম্ভব হলেও উন্নত চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করা তার পক্ষে অসম্ভব। ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার লিটনের চিকিৎসা করছেন। তিনি বলেন, “ছররা গুলিতে যদি খুব অসুবিধা না হয়, তাহলে এসব বের করতে আমি নিরুৎসাহিত করি। কারণ ওর মাথায় যে পনেরোটি গুলি আছে, তার জন্য পনেরোবার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে রোগীর আরও জটিল অবস্থা তৈরি হতে পারে। গুলিগুলো খুব ছোট, কেটে সঙ্গে সঙ্গে বের করা যাবে না।”
শুক্রবার, সাতাশ সেপ্টেম্বর, লিটনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে-বসে কাতরাচ্ছেন তিনি। তার পাশে হতাশা নিয়ে বসে আছেন মা-বাবা। সন্তান সুস্থ হবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তিত তারা। মা লিলি বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ, আর চোখে পানি। লিটন সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, ছাত্র আন্দোলনের সব কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। চার আগস্ট দুপুরে শহরের কোর্ট চত্বরের পূর্ব পাশের গলিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু চলে যাওয়ার সময়ই পুলিশ তাদের দিকে গুলি ছোড়ে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফেরার পর আবারও গুলি করা হলে, তার পুরো শরীর জুড়ে গুলি লাগে। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে বাড়ির লোকজন তার রক্ত ঝরা মাথায় কাপড় বেঁধে দেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকে এবং অন্যদের ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে বারোটি গুলি তার শরীর থেকে বের করা হয়। এর একদিন পর, ছয় আগস্ট, তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সিএমএইচ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন। কিন্তু শরীর থেকে একটি গুলিও বের করা সম্ভব হয়নি।
ব্যথায় কাতর লিটন বলেন, “গুলি লাগার পর শরীরের প্রতিটি জায়গা যেন অবশ হয়ে গেছে। একা কোনো কাজ করতে পারি না, অন্যের সাহায্য নিতে হয়। বসতে, দাঁড়াতে খুব কষ্ট হয়। আবার গরম লাগলে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায়। ঘুমাতে গেলে মাথার গুলির ব্যথায় ঘুম আসে না। সরকারের কাছে আমার একটাই অনুরোধ—শরীর থেকে গুলিগুলো বের করার ব্যবস্থা করা হোক, যেন আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি।”
লিটনের বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, “টানাটানির সংসারে ধার-দেনা করে ছেলের জন্য ওষুধ কিনছি। স্বপ্ন ছিল, ছেলেটা পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেল।” ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল উইংয়ের সদস্য রাকিব ইসলাম জানান, উন্নত চিকিৎসা পেলে লিটন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন।