জাবিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হত্যা: ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের কয়েকজন শনাক্ত
ঢাকা জেলা প্রতিনিধি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গত পনেরো জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে মারধর করে শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ হেফাজতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। একাধিক ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদলের কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
শামীম সাভারের আশুলিয়া থানার কাঠগড়া এলাকার মোল্লাবাড়ীর ইয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার নয়শো নয় থেকে দুই হাজার দশ পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।
শামীম বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল।
জড়িত দুই শিক্ষার্থীসহ ছাত্রদলের কয়েকজন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, গতকাল উনিশ সেপ্টেম্বর বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাঁকে আটক করে গণপিটুনি দেন। এ সময় ভিডিও ফুটেজে লাঠি হাতে তাঁকে মারতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চুরাশি ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিবকে। আর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চুরাশি ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিককে লাথি দিতে দেখা যায়। আহসান লাবিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক।
এই ঘটনায় আহসান লাবিবকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং সুষ্ঠু তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই অব্যাহতি বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
মারধরের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আবার দফায় দফায় তাঁকে মারধর করেন। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থেকে পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
তারা হলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম মোল্লাকে গণপিটুনিতে হত্যার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে ছাত্রদলের যে বেশ কয়েকজন দেখা গেছে, তারা হলেন— সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, রাজু আহমেদ, রাজন হাসান, নাঈমুর রহমান কৌশিক, হামিদুল্লাহ সালমান, এম এন সোহাগ, এবং নাঈম। এছাড়া আতিক নামে আরেকজন শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে ভিডিওতে।
সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া তিরিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া রাজু আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের পঁচচল্লিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থী, রাজন হাসান একই বিভাগের পঁচচল্লিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থী, নাঈমুর রহমান কৌশিক, তেত্রিশতম ব্যাচ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, হামিদুল্লাহ সালমান ইংরেজি পঁচচল্লিশতম ব্যাচের শিক্ষার্থী, নাঈম পঁচচল্লিশতম ব্যাচ, অর্থনীতি বিভাগ এবং এমএন সোহাগ কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চীনে শিক্ষার্থী। তারা সবাই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিরাপত্তা কার্যালয়ের ভেতরে চেক শার্ট পরিহিত অবস্থায় শামীমকে পেটাচ্ছেন রাজু আহমেদ। এ সময় তাঁর হাতে গাছের ডাল দেখা গেছে। এ ছাড়া রাজন হাসানের গায়ে হাফ হাতা লাল রঙের শার্ট দেখা গেছে।
হামিদুল্লাহ সালমানের গায়ে হাফ হাতা শার্ট পরিহিত অবস্থায় ও সোহাগের গায়ে সাদা টি–শার্ট ও চশমা পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, জিনস প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত অবস্থায় শামীমকে মারধর করছেন সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া।
তবে এ ঘটনায় অভিযুক্ত কেউ মারধরের কথা স্বীকার করেনি।
হামিদুল্লাহ সালমান বলেন, ‘প্রান্তিক গেটে তাকে মারধরের সময় আমি ছিলাম না। পরে নিরাপত্তা অফিসে গেলেও আমি তাকে মারধর করিনি।’ তবে, ফেসবুক কমেন্টে তিনি লিখেছেন, ‘ওরে (শামীম) তো বানাইলাম ডেওয়া ভর্তার মতো।’
জাবির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি যখন সবাইকে আটকাতে যাব, তখন আমাকে আহসান লাবিব আটকে রাখে। শামীম যখন পানি খেতে চায়, তখন আমি তাকে পানি দিতে গেলে আমার হাত থেকে পানির বোতল ফেলে দেয়।’
শামীম মোল্লাকে মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে রাত পৌনে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান ও প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলমের উপস্থিতিতে পুলিশ শামীম মোল্লাকে আহত অবস্থায় আটক দেখিয়ে নিয়ে যান। এরপর তাঁকে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে তাঁকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয় বলে নিশ্চিত করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান সেলিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে তাঁকে রাত নয়টার দিকে নিয়ে আসা হয়। যখন আনা হয়, তখন আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে তিনি মৃত। আমাদের এখানে আসার আগেই তিনি মারা যান। তাঁর শরীরে সে রকম গুরুতর কোনো ক্ষত পাওয়া যায়নি। আর কী কারণে মারা গেছে, এটা জানার জন্য ময়নাতদন্ত করতে হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার খবর পেয়ে আমাদের একটা টিম সেখানে যায়। তারা আমাদের কাছে শামীম মোল্লা নামে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর আমরা তাকে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাই। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমরা এখনো হাতে পাইনি। তবে যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আমরা তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। এ ঘটনায় আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব। তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা হবে।’
বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ
এদিকে এ ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শামীম মোল্লার ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ উল্লেখ করে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে পৃথক দুটি বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিক্ষার্থীরা।
বেলা এগারোটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া মঞ্চ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল শেষে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তাঁরা।