ইসরাইলের একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলায় যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে গাজা। এক সপ্তাহ ধরে চলা বর্বর এ হামলায় দুই শতাধিক নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েকশ। নিহতদের মধ্যে ৫৮ জনই শিশু।
আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, গাজায় প্রতি ঘণ্টায় তিনটি শিশু আহত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং আন্তর্জাতিক মহলের যুদ্ধ বিরতির দাবি নাকচ করে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল।
সোমবার গাজা ও পশ্চিমতীরে বেশ কয়েকটি কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আবাসিক ভবনে হামলা চালায় দেশটি। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরটির একটি বড় অংশ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসরাইলের এমন নির্লজ্জ আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে ফের ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘও। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে রোববারের বৈঠকও শেষ হয়েছে কোনো ফলাফল ছাড়া। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের।
ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর রোববার ছিল ভয়াবহ দিন। এদিন দেশটির টানা বিমান হামলায় ১৬ নারী ও ১০ শিশুসহ ৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। রাতভরও গাজার রাস্তা, নিরাপত্তা ভবন, হামাসের ট্রেনিং ক্যাম্প ও আবাসিক ভবনগুলোতে বোমা মেরেছে ইসরাইল। সোমবার কয়েকটি তোশক কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাসাবাড়ি ও মসজিদে বিমান হামলা চালায় দেশটি। তাৎক্ষণিকভাবে এদিনের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে।
গাজা ইলেক্ট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানিয়েছে, গাজা শহরের ‘একটি বড় অংশ’ বিদ–্যৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের দক্ষিণের একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ লাইন ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এক ফেসবুক পোস্টে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু গত সপ্তাহে। জেরুজালেমের আল-আকসায় পবিত্র জুমাতুল বিদা আদায়কে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। বলা হচ্ছে, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের ঘটনা।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইরান, অস্ট্রেলিয়া ও মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি। রোববার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগানের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে ড. হাসান রুহানি এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন এখনও মুসলিম উম্মাহর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অভিন্ন একটি ইস্যু।
নিরুপায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতা অবসানের জন্য তেল আবিবকে মোকাবিলা জরুরি বলে জানান তিনি। টেলিফোন আলাপে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, ইসরাইলকে মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভবে কাজ করতে হবে। এছাড়া হামলা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান।
যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় আবারও ব্যর্থ জাতিসংঘ : ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনার জন্য চীন, তিউনিসিয়া ও নরওয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রোববার জরুরি বৈঠকে বসেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে আবারও ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। নিরাপত্তা পরিষদের রোববারের বৈঠকও শেষ হয়েছে কোনো ফলাফল ছাড়া। এদিন বাইডেন প্রশাসনের আপত্তিতে ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানানোর বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পরিষদ।
আগের দুটি বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ এবং ইসরাইলের নিন্দা জানানো সম্ভব হয়নি। ওই বৈঠকগুলোতে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪টি দেশই সহিংসতা কমানোর আহ্বান জানালেও বিরোধিতা করে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র।
তৃতীয় বৈঠকে চীন, নরওয়ে ও তিউনিসিয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজায় সৃষ্ট মানবেতর পরিস্থিতি এবং বেসামরিক মানুষজনের প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করে সব আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুতে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
বাঁচলেন না গাজার দুই চিকিৎসকও : অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় দুই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকও নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলো। তাদের মৃত্যু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি বাড়াবে বলে জানিয়েছেন তারা। নিহতরা হলেন- গাজার আল-শিফা হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ মেডিসিনের প্রধান ডা. আয়মান আবু আল-উফ এবং ৬৬ বছর বয়সি সাইকিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট ডা. মুইন আহমদ আল-আলোয়াল।
রোববার সকালে গাজার আল-ওয়হেদা জেলার নিজ বাসায় ছিলেন ডা. আয়মান আবু আল-উফ। এ সময় ইসরাইলি বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনিও নিহত হন। একই দিন নিজ বাড়িতে নিহত হন ডা. মুইন আহমদ আল-আলোয়ালও।
আমাদের ফেইসবুক Link : ট্রাস্ট নিউজ ২৪