মামলা, গ্রেপ্তার, নানা বিতর্ক ও সমালোচনার পর আবারও কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। উচ্চ আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানির দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেলের স্ত্রী ও কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন।
তবে এবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ধরন কী হবে, অর্থাৎ ক্যাশ অন ডেলিভারি নাকি ধরন পাল্টাবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গিয়েছে । একদিকে পুরনো গ্রাহকের পণ্য ও টাকা ফেরত দিতে হবে, অন্যদিকে নতুন গ্রাহকদের সেবা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালু রাখার মতো কঠিন কাজ চালিয়ে যেতে হবে। গ্রাহক ঠকানোর মামলায় রাসেল এখনো কারাগারে। জামিনে বের হওয়া তার স্ত্রীকে নিয়ে করা বোর্ড গ্রাহকদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা গৃহিণী কাকলী আক্তার ইভ্যালিতে এয়ার কন্ডিশন (এসি) অর্ডার করে আজও পণ্য কিংবা টাকা হাতে পাননি। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘৭৯ হাজার টাকা দামের এসি কিনতে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছি। কিন্তু জিনিস বা টাকা হাতে পাইনি। শুনেছি ইভ্যালি আবার চালু হচ্ছে। তা হলে কি পণ্য পাব, নাকি টাকা ফিরে পাব- কিছুই পরিষ্কার নয়। পেলেও কবে পাব, বুঝতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগের গ্রাহকদের পণ্য ও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এর মধ্যে নতুন করে গ্রাহকদের কীভাবে সেবা দেবে? নতুন করে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কিনা- তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।’
গৃহিণী কাকলী আক্তারের মতো অসংখ্য ইভ্যালির গ্রাহকের পাওনা টাকা ও পণ্যের দাবিতে গ্রাহকদের বিক্ষোভের জের ধরে গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর নিজেদের অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছিল ইভ্যালি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে তখন ইভ্যালির দেনা ছিল ৫৪৩ কোটি টাকা। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহক ছিল দুই লাখেরও বেশি। অপরদিকে রাসেলের সময়ে পরিচালিত কর্মকা- অডিট করে ৪৭ হাজার কোটি টাকার হদিস পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিদায়ী বোর্ডপ্রধান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এরই মধ্যে রাসেলের স্ত্রী, শাশুড়ি এবং একজন নিকটাত্মীয়কে নিয়ে নতুন একটি বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। রাসেলের স্ত্রী এই মামলায় কারাবাস শেষে গত এপ্রিলে জামিনে মুক্তি পান।
আগামীকাল রবিবারের মধ্যে নতুন বোর্ড গঠনের কার্যক্রম সম্পন্ন হবে বলে জানান শামীমা নাসরিনের আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেন, নতুন বোর্ড তাদের নিজস্ব কৌশলে ব্যবসা পরিচালনা করবে। ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার মার্চেন্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যে তাদের পণ্য ও বিনিয়োগ দিয়ে ব্যবসা চালু করবেন। ইভ্যালি চেষ্টা করবে ব্যবসার অর্থ দিয়ে পুরনো গ্রাহকদের পাওনা এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে।
ইভ্যালির কাছে আগের গ্রাহকদের যে টাকা আটকে আছে, তা তারা কীভাবে ফেরত পাবেন কিংবা যাদের অর্ডার আটকে ছিল তারা কীভাবে সেটি পাবেন, এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। ওদিকে ইভ্যালির কাছেও গ্রাহকদের পাওনার সঠিক হিসাব নেই বলে জানান আহসানুল করিম। তিনি জানান, ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেলের পাসওয়ার্ডে বন্দি রয়েছে সব তথ্য। আহসানুল করিম দাবি করেন, রাসেল যদি বের হতে পারেন, তা হলে আশা করা যায় গ্রাহকদের তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যাবে। নতুন বোর্ড গঠন হলে এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে।
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভ্যালির ফেসবুক পেজে গতকাল শুক্রবার জানানো হয়, আগের অর্ডার ডেলিভারি, গেটওয়ের টাকা এবং দেনা পরিশোধ সংক্রান্ত সব আপডেট নিয়ে শিগগিরই একটি প্রেস কনফারেন্স ডাকা হবে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইভ্যালির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজটি আবারও চালু হয় এবং পেজটি থেকে ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেওয়া হয়।
নতুন বোর্ডে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ই-ক্যাবের প্রতিনিধি থাকায় গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিনা তা নজরে থাকবে বলে জানান বিদায়ী বোর্ডপ্রধান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা নিয়ে তারা নিজেদের কাজে খরচ করেছেন। অডিট প্রতিবেদনে আমরা পেয়েছি বিপুল অর্থ কোথা থেকে এলো, কোথায় গেল তার কোনো তথ্য নেই। অনেক ভাউচার পেয়েছি, যেখানে টাকার অঙ্ক লেখা আছে; কিন্তু কাকে দেওয়া হলো তা উল্লেখ করা নেই। এতসব অভিযোগ যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, সেখানে গ্রাহকদের সন্দেহ থাকবেই। তবে আমি বলব গ্রাহকরা যেখান থেকেই পণ্য কিনুক না কেন, বুঝে শুনে কিনতে হবে।’
ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু এবং পুরনো গ্রাহকের পাওনা ফেরত কতটুকু সম্ভব সে বিষয়ে জানতে চাইলে বিদায়ী বোর্ডপ্রধান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিবেদনেও বলেছি বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে এ কোম্পানি খোলার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো বিনিয়োগকারী বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসে, তা হলেই শুধু এটা সম্ভব। কারণ ইভ্যালির কাছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রয়েছে। তা দিয়ে কোম্পানি দাঁড় করানো কিংবা পুরনো গ্রাহকের পাওনা ফেরত কোনোটাই সম্ভব নয়।’
ইভ্যালি পূনরায় চালু এবং গ্রাহক স্বার্থের প্রসঙ্গে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন শিপন বলেন, বর্তমানে অনলাইন প্লাটফরমে যে কোম্পানিই ব্যবসা পরিচালনা করুক, তাদের ডিজিটাল কমার্স গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে। এ গাইডলাইন মেনে চললে গ্রাহকদের স্বার্থ অক্ষুণœ থাকবে। তা ছাড়া নতুন বোর্ডে ই-ক্যাবের প্রতিনিধি থাকছে। সুতরাং ভোক্তা স্বার্থের দিকটি নজরদারিতে থাকবে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহবুব কবীর মিলন বলেন, ‘আমরা ইভ্যালির ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী। নতুন পরিচালনা পর্ষদ তহবিল আনতে পারলে ও ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। তবে গ্রাহক মার্চেন্ট সবাইকেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।’