নেই বৃষ্টি এরপরও বাড়ছে নদীর পানি। গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢল মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। দিনাজপুর জেলার পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিতে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এখনও পানিবন্দি হাজারও পরিবার। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু স্থানে বা বাঁধের ওপর।
পানিবন্দি ও গৃহহীন মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৯০০টি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৩ মেট্রিক টন চাল। খিচুড়ি রান্না করে দুর্গত পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর পুনর্ভবা নদীর বিপদসীমা ৩৩ দশমিক শূন্য ৫ মিটার। সেখানে সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টা পর্যন্ত পানি প্রবাহিত হয় ৩৩ দশমিক ১৪ মিটার। অর্থাৎ বিপদসীমার শূন্য ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে ।
এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন সদরের খামার ঝাড়বাড়ী, হীরাহার, বালুয়াডাঙ্গা, মাঝাডাঙ্গাসহ কয়েকটি এলাকার প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ। পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় দিনাজপুর পুনর্ভবা নদীর তীরের বাঁধে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ৭টি পরিবার। এছাড়াও বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই।
সোমবার সন্ধ্যায় পুনর্ভবা নদীর তীরে লালবাগ এলাকায় গেলে বাঁধের ওপর অশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিরা জানান, বাড়িতে এক বুক বা তারও ওপর পানি। ফলে বাড়িতে আর থাকা যাচ্ছে না। পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ফলে তারা বাধ্য হয়েই এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। বাড়ি থেকে কোনও কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি।
ওই এলাকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, নদীর তীরে বাড়ি। তাই একটুতেই পানি প্রবেশ করে। গত কয়েকদিন ধরে অব্যাহতভাবে বৃষ্টির পরও পানি বাড়িতে ওঠে। তবে রবিবার রাত থেকে পানি যেভাবে বাড়তে শুরু করে, একারণে সোমবার সকালেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, বাড়িতে থাকা যায় না। বাড়ি থেকে কোনও কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখন বাঁধের ওপর রাত কাটাতে হবে। আমাদের খাওয়ার মতোও কিছু নাই। যদি সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয় তাহলে বেশ উপকার হয়। এই এলাকার মেম্বার/কাউন্সিলর/মেয়ররা তো আমাদের খোঁজ রাখে না।
ওই স্থান থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দুরেই মাঝাডাঙ্গা এলাকা। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বেশ কয়েকটি পরিবার। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছেন। খুব প্রয়োজনে অনেকেই বুক পানি মারিয়ে আসছেন। তবে যেভাবে পানি বাড়তে তাতে করে এক প্রকার আতঙ্কিত তারা।
কথা হলে মাঝাডাঙ্গা এলাকার সেলিম রেজা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে পানি হয়েছে এজন্য এক প্রকার বন্যা দেখা দিয়েছে। গত ৩ দিন দিন ধরে এই এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবার পানিবন্দি। এখন বৃষ্টি নাই, তারপরও পানি বাড়ছে।
সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের নতুনপাড়া ও খামার কাচাই এলাকার চিত্রও প্রায় একই। ওই এলাকার তিন শতাধিক পরিবারের মানুষজন পানিবন্দি। বাড়ি থেকে বের হতে হলে বুক পানি মারিয়ে আসতে হয়।
দুপুরে পানিবন্দি চার শতাধিক পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ। এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দেবাশীষ চৌধুরী, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আনিছুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলম, সহকারী কমিশনার (ভুমি) সাথী দাস, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদ সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ বলেন, দিনাজপুরে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে ৯ শতাধিক পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৫৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। যেসব মানুষ রান্না করে খাওয়ার মতো অবস্থায় নাই, তাদের খিচুড়ি রান্না করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও তাদের জিআর প্রকল্প থেকে চালের ব্যবস্থা করে প্রতি পরিবারকে ১০ থেকে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।
এদিকে শুধু মানুষজনই নয়, পানি নিচে তলিয়ে গেছে দেড় হাজার হেক্টর জমির ধান। এসব ধান নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা। বিশেষ করে যেসব ধান পেকে গেছে, আর কয়েকদিন পরেই উঠতো কৃষকের গোলায়। সেসব ধান গজিয়ে বা পচে গিয়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
মাঝাডাঙ্গা এলাকার কৃষক ফিরোজুল ইসলাম বলেন, প্রায় দেড় বিঘা জমির ধান পেকে গিয়েছে। এসব ধান আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘরে উঠতো। এখন এসব ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে করে এসব ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। যদি এটি হয় তাহলে আমাদের অনেক লোকসান পোহাতে হবে।
গোসাইপুর এলাকার একরাম হোসেন বলেন, আমাদের জমির ধান ডুবে গেছে। এক বিঘা জমির বেগুন ও মরিচ গাছ ডুবে গেছে। আলুর ক্ষেত তৈরি করেছিলাম সেটি ডুবে গেছে। এটা আমাদের জন্য বড় একটি ক্ষতি। ধান, বেগুন ও মরিচ ক্ষেতে অনেক লোকসান হবে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নুরুজ্জামান বলেন, প্রায় ১৬০০ হেক্টর জমির ধান ডুবে গেছে। তবে নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমরা আশা করছি দ্রুত পানি নেমে যাবে। আর পানি নেমে গেলে যেসব ধান পেকেছে সেসব ধান দ্রুত কাটা ও মাড়াই করে শুকাতে দিতে হবে। তাহলে তেমন ক্ষতি হবে না। পানি নেমে গেলে সবজি ক্ষেতও কিছুটা রক্ষা পাবে।
আমাদের ফেইসবুক লিংক : ট্রাস্ট নিউজ ২৪