মোরশেদ-উল-আলম, চিরিরবন্দর প্রতিনিধি ঃ সম্প্রতি দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চিকিৎসার অভাবে চিরিরবন্দরের আব্দুলপুর ইউনিয়নের আব্দুলপুর (বানিযুগি) গ্রামের শহিদুল ইসলাম নামের অসুস্থ্য এক নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে নিহতের পরিবারসহ খনি শ্রমিকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নিহত নিরাপত্তা কর্মীর স্ত্রী তার স্বামীর অকাল মৃত্যুর জন্য খনির কতিপয় কর্মকর্তার নির্মম অবহেলাকে দায়ী করে অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহনসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবী জানিয়েছেন। দাবী মানা না হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করার চিন্তা ভাবনা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি। ন্যায় সঙ্গত এ দাবির প্রতি সমর্থনও জানিয়েছেন খনির সকল পর্যায়ের শ্রমিক ও কর্মচারীগন।
নিহত নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা অনুসন্ধান করতে ২৫জুলাই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকায় গেলে খনির আবাসিক গেটে এসে ভেতর থেকে একাধিক শ্রমিক নেতা ও নিরাপত্তা কর্মী নিহত শহিদুল ইসলামের মৃত্যুর কারন বর্ননা করে বলেন, গত ১৭ জুলাই দুপুরে নিরাপত্তা কর্মী শহিদুল ইসলাম খনি অভ্যন্তরে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে নিরাপত্তা সুপারভাইজার আব্দুর রশিদকে খবর দেয়া হয়। নিরাপত্তা কর্মী বিষয়টি তাৎক্ষনিক নিরাপত্তা ইন্চার্জ ইমাম হাসানকে জানাতে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে বিকেল আনুমানিক সোয়া ৩টার দিকে তিনি শহিদুল ইসলামের অসুস্থ্যতার খবরটি জানতে পারেন। তারপর প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হলেও তিনি খনির অভ্যন্তরে থাকা নিজস্ব এ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বিলম্ব করেন। এ সময় নিরাপত্তা সুপারভাইজার আব্দুর রশিদ উপায়ান্তর না পেয়ে খনির ১নং গেটে থাকা নিরাপত্তা কর্মী বাবলুকে বাহির থেকে অটোরিক্সা আনতে বলে। অটোরিক্সা আনা হলে সেই অটোরিক্সাটিকেও খনির ভেতরে আসতে দেয়া হয়নি। ফলে চিকিৎসার অভাবে আনুমানিক ৪টা ৪০ মিনিটের সময় ঘটনাস্থলেই অসুস্থ্য শহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন, মৃত্যুর আধাঘন্টা পরে সিকিউরিটি ইন্চার্জ ইমাম হাসান ঘটনাস্থলে এসে চিরনিদ্রায় শায়িত শহিদুলের লাশ দেখে উপহাস করে বলেন, সে (নিরাপত্তা কর্মী) মৃত্যুর ভান করছে খনির বাহিরে যাওয়ার জন্য। তার এই বিরুপ মন্তব্যে তাৎক্ষনিক শ্রমিক ও নিরাপত্তা কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা নিরাপত্তা ইন্চার্জসহ প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাগনের অপসারন দাবী করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
খনির নিরাপত্তা ইন্চার্জ আব্দুর রশিদের মুঠোফোনে কথা হলে তিনি অকপটেই বলেন, সিকিউরিটি ইন্চার্জ ইমাম হাসানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে ডিপুটি ম্যানেজার আকতার হোসেনকে কল করা হলে তিনি কল কেটে দেন। এরপর এসিসটেন্ট ম্যানেজার রাসেল আল মামুনকে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেন। তাকে সমস্যার কথা বলা হলে তিনি এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর আশ^াস দেন। কিন্তু বিকেল ৪টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। বিলম্বে এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর কারনেই নিরাপত্তা কর্মী শহিদুল ইসলামের মৃত্যুর কথাটি তিনি স্বীকার করেন।
এদিকে খনি শ্রমিকদের ভাষ্য নেয়ার পর গত ২৮ জুলাই বুধবার সন্ধায় নিহত নিরাপত্তা কর্মী শহিদুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি চিরিরবন্দর উপজেলার আব্দুলপুর (বানিযুগি) গ্রামে গেলে শহিদুলের স্ত্রী রেহেনা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, সিকিউরিটি ইন্চার্জ ও খনি প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার কারনেই আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, আমার স্বামীর চাকুরী ছাড়া কোন ফসলী জমি নেই যা দিয়ে বৃদ্ধ শ^াশুড়িসহ পরিবারের ৪ জন সদস্যের ভোরন-পোষন ও লেখাপড়ার খরচ চালাব। তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী নিরাপত্তা ইন্চার্জ ইমাম হাসানসহ দোষী সকল কর্মকর্তার শাস্তি দাবীসহ স্বামীর ইন্সুরেন্সের টাকা ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০ লাখ টাকা দাবী করেন। এছাড়া তিনি কয়লা খনিতে একটি চাকরীও দাবী করেন। দাবী মানা না হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে তিনি উচ্চ আদালতের স্মরনাপন্ন হবেন বলেও সাফ জানিয়ে দেন।
তিনি আরো বলেন, গত ১৭ জুলাই তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্ধায় পার্বতীপুর মডেল থানায় ঘটনার পূর্ণ বিবরন দিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরপর রাতে খনির ভেতরে এক সমঝোতা বেঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খনি প্রশাসনের লোকজন আমাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫লাখ টাকা প্রদান ও খনিতে চাকুরি প্রদানের আশ^াস দেন। এতে আমি আশ^স্থ নই। একটি মানুষের মূল্য ও পরিবারের ক্ষতিপূরণ কি ৫ লাখ টাকায় হয়? তিনি অভিযোগ করেন, ইতিপূর্বেও খনিতে কর্মরত অনেক শ্রমিক ও কর্মচারীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে চাকুরী দেয়ার আশ^াস দেয়া হলেও অনেকের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন কর্তৃপক্ষ।
অভিযুক্ত সিকিউরিটি ইন্চার্জ ইমাম হাসানের মুঠোফোনে তার বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে কথা হলে তিনি সুনিদিষ্টভাবে কোন মন্তব্য না করে বলেন, মোবাইলে কথা বলা সম্ভব নয়। খনির গেটে দেখা করতে বলেন।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) কামরুজ্জামান এর সাথে কথা বলতে তার মুঠোফোনে কলা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
খনিতে অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকে থাকা পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাশিদ কায়সার রিয়াদের মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, সিকিউরিটি ইন্চার্জ ইমাম হাসানের অবহেলার কারনে নিরাপত্তা কর্মী শহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে মর্মে খনি শ্রমিকদের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। আমি বিষয়টি অবগত আছি। তবে কেপিআইভূক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এ বিষয়ে আমার কিছুই করার নেই। বিষয়টি তাদের আভ্যন্তরিন তদন্তের বিষয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।