সাধারণত বিষাক্ত মেথিলেটেড স্পিরিট ট্যানারি শিল্পে, কাঠের আসবাব রং করার কাজে ব্যবহার হয়।
মাত্র ১০ মিলি লিটার (দুই চা চামচের একটু বেশি) এই স্পিরিট খেলেই চোখ জ্বালাপোড়া করে অন্ধত্ববরণ করতে হবে। আর বেশি খেলে কোমায় গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু হবে।
সহজলভ্য এবং দাম কম হওয়ায় এই স্পিরিটে অবৈধভাবে বিষাক্ত মদ তৈরি হচ্ছে। গত এক মাসে এই স্পিরিটে তৈরি মদ খেয়ে সারা দেশে ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর আগেও একই ধরনের স্পিরিট পানে অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
সাধারণত দেশি-বিদেশি মদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় রেক্টিফায়েড স্পিরিট। ৯৫ শতাংশ ইথাইল অ্যালকোহলের জলীয় দ্রবণকেই রেক্টিফায়েড স্পিরিট বলা হয়। এছাড়া হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতেও অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে এই স্পিরিটও ব্যবহার হচ্ছে। রেক্টিফায়েড স্পিরিট খেয়ে কেউ মারা যান না। তবে মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে তৈরি বিষাক্ত মদ খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছেন। কারণ এটা বিষাক্ত। সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক লিটার রেক্টিফায়েড স্পিরিটের দাম যেখানে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা, সেখানে সমপরিমাণ মেথিলেটেড স্পিরিটের দাম ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা। সহজেই পাওয়া যায়। যে কেউ কিনতে পারে।
দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেকে বেশি লাভের আশায় মেথিলেটেড স্পিরিটের সঙ্গে ফ্লেভার এবং রং মদ তৈরি করছে। এ কারণে মেথিলেটিড স্পিরিটের সহলভ্যতা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তারা অবৈধ মদ ও বিষাক্ত স্পিরিট বিক্রির বিষয়ে বাজার মনিটরিং করার পরামর্শ দেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বৈধ চ্যানেলে বিদেশি মদ আসা অনেক কমে গেছে।
এ কারণে ওয়্যারহাউজগুলো থেকে বৈধ মদ অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁ এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছে যাচ্ছে না। কাজেই স্থানীয় পর্যায়ে বিদেশি মদের চাহিদা থাকলেও সেভাবে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এই সুযোগে সরবরাহকারীরা ভেজাল মদ তৈরির দিকে ঝুঁকেছে। তারা সহজলভ্য এবং কমদামি স্পিরিট কিনে এগুলো তৈরি করছে। এসব খেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আফতাব আলী শেখ যুগান্তরকে বলেন, মদ তৈরির জন্য সাধারণত রেক্টিফায়েড স্পিরিট ব্যবহার করা হয়। এতে ইথাইল অ্যালকোহল থাকে বা ইথানল থাকে।
এতে নানা ধরনের প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে মদ তৈরি করে বাজারজাত করা হচ্ছে। কিন্তু মেথিলেটেড স্পিরিট ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীরা মদ তৈরি করে বাজারজাত করছে। এই স্পিরিট কাঠে রং দেয়ার জন্য বার্নিশের কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি সস্তায় পাওয়া যায়।
এটা ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাত্র ১০ মিলি লিটার মেথিলেটেড স্পিরিট পান করলে চোখ জ্বালাপোড়া করে মানুষ অন্ধ হয়ে যাবে। আর বেশি খেলে কোমায় গিয়ে মৃত্যুবরণ করবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা যুগান্তরকে বলেন, রেক্টিফায়েড স্পিরিটে ৯৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে। এই স্পিরিটে তৈরি মদ খেয়ে কেউ মারা যান না। সম্প্রতি যারা ভেজাল মদ খেয়ে মারা যাচ্ছেন এটা তৈরি করা হয়েছে মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে। এর আগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল মদ খেয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিরাও মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে তৈরি মদ খেয়ে মারা গেছেন।
মেথিলেটেড স্পিরিট সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা এক কথায় বিষ। এগুলো বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে, বার্নিসে, ট্যানারি শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এই স্পিরিটে তৈরি মদ খেলে শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা হয়, যা মৃত্যুর কারণ।
এমন বিষাক্ত স্পিরিট মদ তৈরিতে কেন ব্যবহার করা হচ্ছে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, সম্প্রতি বিদেশি মদের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় অনেক জোগানদাতা নিজেরাই ভেজাল মদ তৈরির ব্যবসায় নামে। তারা জানেন স্পিরিট, রং এবং বিদেশি মদের ফ্লেভার মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করা যায়। কিন্তু রেক্টিফায়েড স্পিরিট এবং মেথিলেটেড স্পিরিটের পার্থক্য তারা জানেন না। ফলে কমদামি স্পিরিট কিনে ভেজাল এবং বিষাক্ত মদ তৈরি করছে। না জেনে এসব খেয়ে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কৌশিক সাহা যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন কারণে একটা দ্রবণ আমাদের শরীরে বিষাক্ত হতে পারে।
এটা পদার্থের ধর্ম। মেথিলেটেড আমাদের শরীরের জন্য বিষাক্ত। ব্যবসায়ীরা লাভ বেশি করার জন্য এই স্পিরিট ব্যবহার করে। এ কারণে দুর্ঘটনাগুলো হয়। এটার যত্রতত্র ব্যবহার রোধে বাজার মনিটরিং করা জরুরি।
আমাদের ফেইসবুক Link : ট্রাস্ট নিউজ ২৪