কম দামে পণ্য বিক্রির প্রলোভনে লাখ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির নথিপত্র চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব নথিপত্র চাওয়া হয়। এর বাইরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ইভ্যালির দুর্নীতি তদন্ত করছে। ইভ্যালির অর্থ লোপাটের ঘটনায় চতুর্মুখী তদন্ত শুরু হয়েছে।
এদিকে, দুদকের তদন্ত চলাকালীন ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরীন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেল যেন বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে দুদক। দুদকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এ বিষয়ে বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে অনুসন্ধান টিম।
সচিব বলেন, ইভ্যালি নিয়ে শুধু আমরা একা নই, অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সেসব সংস্থার তদন্তের অগ্রগতি কিংবা যে পদক্ষেপ নেবে, সেগুলোও আমরা অনুসন্ধানে স্বার্থে আমলে নেব। মানিল্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ কিংবা জনগণ বা রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের বিষয় জানান চেষ্টা চলছে। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান এখনো চলমান। আইন অনুযায়ী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনে অনুসন্ধান টিম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইভ্যালির মালিক দেশের লাখ-লাখ মানুষকে কম দামে পণ্য দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের একটি দল অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। দুদক ছাড়াও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, সিআইডি ইভ্যালির অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করছে। দুদকের অনুসন্ধানী দল এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তের দিকে নজর রাখছে। এসব সংস্থার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সথে দুদকের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয় করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া দুদক ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডির ওপর নজর রাখছে। এর পাশাপাশি ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডি দেশে অন্য কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালু করছে কিনা সেদিকে নজর রাখছে।
জানা গেছে, ইভ্যালির ট্যাক্স ফাইল, ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের রেকর্ডপত্র, অডিট রিপোর্ট এবং নিবন্ধিত মার্চেন্টের তালিকাসহ তলবকৃত অনেক নথিপত্রের বেশ কিছু দুদকের এসেছে। সব নথিপত্র এখনো পায়নি দুদক। যেসব নথিপত্র ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, ইভ্যালির অনিয়ম, দুর্নীতিসহ সার্বিক কার্যক্রম তদন্ত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে ইভ্যালির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্যও নিয়েছে কমিটি। দুদক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চলমান তদন্তের দিকেও খেয়াল রাখছে। প্রতিষ্ঠানটির তদন্ত শেষে মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নেবে, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাও সংগ্রহ করবে দুদক। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ইভ্যালিসহ যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ৫০ লাখ টাকার বেশি লেনদেন করেছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদন দেবে, ওই প্রতিবেদনও দুদক সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি তদন্ত কমিটি ইভ্যালির ট্যাক্স ফাইল পর্যালোচনা করছেন। তারাও এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেবে, ওই প্রতিবেদনও সংগ্রহ করবে দুদক। ইভ্যালির ঘটনা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুদক সিআইডির তদন্ত রিপোর্টও সংগ্রহ করবে।
জানা গেছে, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির হাতিয়ে নেওয়া ৩৩৯ কোটি টাকার ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ৪ জুলাই ইভ্যালির দুর্নীতি দমন কমিশনসহ চারটি সরকারি সংস্থাকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্য সংস্থাগুলো হচ্ছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ওই চিঠির পাওয়ার পর ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৮ জুলাই দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীকে প্রধান করে দুই সদস্যের অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির বিষয়ে দুদকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৪ মার্চ ইভ্যালির মোট সম্পদ পাওয়া যায় ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা। প্রতিষ্ঠান মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা। ওই তারিখে ইভ্যালির গ্রাহকের কাছে দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মাচের্ন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম হিসেবে নেওয়া ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছ থেকে নেওয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকার মালামালসহ প্রতিষ্ঠানটির ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ৯১৪ টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা। কিন্তু এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকার কোনো হদিস নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইভ্যালির সম্পদ দিয়ে মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করা যাবে বা অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে। বাকি গ্রাহক এবং মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। তদুপরি গ্রাহক ও মার্চেন্টের কাছ থেকে নেওয়া ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ টাকা আত্মসাৎ বা গোপনে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের আলোকে ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক কোনো আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
দুদকের তথ্যমতে, দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরীন ও এমডি মো. রাসেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে গত ৯ জুলাই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চিঠি পাঠায়। এর পর আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুদকের অনুসন্ধানী দল গ্রাহকের দায়-দেনাসহ ব্যবসার যাবতীয় নথিপত্র চেয়ে ইভ্যালিকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সব নথিপত্র দুদককে দাখিলের জন্য বলা হয়। চিঠিতে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়া তথ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে- কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনার জন্য সব ধরনের লাইসেন্স; ব্যবসায়িক মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য, কতগুলো ক্রয় আদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি, ওইসব আদেশের বিপরীতে টাকার পরিমাণ কত, ক্রেতার আদেশের বিপরীতে বকেয়া কীভাবে হলো, কোন পদ্ধতিতে হলো- এসব তথ্য; গ্রাহকের দায় শোধ করতে তাদের পরিকল্পনা, বিদ্যমান ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলায় তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং ব্যাংকের ঋণসহ (যদি থাকে) সব রকম দায়-দেনার হিসাব।
এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরু হওয়ার পর ইভ্যালি এখন পর্যন্ত কতজন গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করেছে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কত টাকার ভ্যাট, ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন অর্থবছরে কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন, কোম্পানির সার্বিক খরচের হিসাব, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খরচ হওয়া অর্থের উৎস, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্যের অফারে এ পর্যন্ত গ্রাহকদের ছাড় দেওয়া টাকার পরিমাণ, এখন পর্যন্ত যত টাকার অফার দেওয়া হয়েছে, তার মোট মূল্যের হিসাবের তথ্য চায় দুদক। ওই চিঠি পাওয়ার রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক, সিটি করপোরেশন ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) অনুমোদন-সংক্রান্ত নথিগুলো দাখিল করে। বাকি নথিপত্র জমা দেওয়ার জন্য সময় চেয়ে নেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইভ্যালির ঘটনা অনুসন্ধান চলছে। তাদের কাছ থেকে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে তার কিছু জমা দিয়েছে। সব নথিপত্র এখনো জমা দেয়নি। নথিপত্র পেলে তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া দুদক অন্যান্য যেসব সরকারি সংস্থা ও দপ্তর ইভ্যালির অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করছে সেদিকে নজর রাখছে। অনুসন্ধানের প্রয়োজেনে ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অনুসন্ধানে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের তথ্যমতে, ইভ্যালি ব্যবসার জন্য নিবন্ধন নেয় ২০১৮ সালের ১৪ মে। আনুষ্ঠানিক ব্যবসা শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বর থেকে। শুরুতেই তারা নানা ধরনের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় অফার দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক কম মূল্যে একের পর এক পণ্য বিক্রির অফার দিতে থাকে তারা। কিছু গ্রাহককে বড় অঙ্কের ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য সরবরাহ করে এ প্রচার চালানো হতো। ২০০ থেকে ৩০০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফারও ছিল তাদের। অসংখ্য গ্রাহক কম দামে পণ্য কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু পণ্যের মূল্য পরিশোধ করলেও তারা তাদের কাক্সিক্ষত পণ্য এখনো পাননি। ইভ্যালি ইতোমধ্যে জানিয়েছে, সারাদেশে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৭০ লাখ। ইভ্যালির কার্যক্রম বন্ধ হলে বঞ্চিত গ্রাহকরা তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাবে না। গ্রাহক যাতে পাওনা টাকা ফেরত পায়- অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধানের পাশাপাশি দুদক এ বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে।
আমাদের ফেইসবুক Link : ট্রাস্ট নিউজ ২৪