দীপিকা পাড়ুকোন কেমন? অভিনয়ে বাঁচেন? প্রতিহিংসাপরায়ণ? অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন? যে কোনো সময় মানসিক বিপর্যয়ে তলিয়ে যান? অনেকেই জানেন না, যে অভিনয় তাকে অর্থ-নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি দিয়েছে সেই অভিনয়ই তার রাতের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে। ১৫ বছর ধরে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি সাফল্য দেখেছেন। তারপরও তার আতঙ্ক, যদি আর ভালো চরিত্র না পান! এই ভয় আজও তাকে মাঝ রাতে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
পারিবারিক পরিচয় বলছে, সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছেন দীপিকা পাড়ুকোন। জাতীয় স্তরের ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় প্রকাশ পাড়ুকোন তার বাবা। প্রকাশ নিজেও চূড়ান্ত রমণীমোহন ছিলেন! তার দুই মেয়ে দীপিকা আর অনীশা। দুই মেয়েই খেলায় তুখোড়। হাতে তুলে নিলেই ব্যাডমিন্টন র্যাকেট যেন তাদের কথা শুনত। দশম শ্রেণিতে উঠেই স্বপ্ন বদলে গেল প্রকাশের বড় মেয়ের। ঠিক করলেন, সবুজ কোর্ট নয় রুপালি পর্দায় দাপিয়ে বেড়াবেন।
দীপিকার এ চাওয়ায় কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি প্রকাশ এবং তার স্ত্রী উজ্জ্বলা পাড়ুকোন। দীপিকাও ক্রমশ নিজেকে তৈরি করতে থাকেন অভিনয়ের জন্য। শুরু করেন মডেলিং। প্রথম সারির বিজ্ঞাপনের প্রচার মুখ ছিলেন তিনি। তবে অভিনয় দুনিয়ার নজর কাড়েন ক্লোজ আপের বিজ্ঞাপন দিয়ে। পাজামা-টপ পরা দীপিকার মুখের সারল্য, ঝলমলে হাসি ভালো লেগেছিল বলিউডের।
দীপিকা এর পরেই সুযোগ পান হিমেশ রেশমিয়ার মিউজিক ভিডিও ‘নাম হ্যায় তেরা’ তে (২০০৬)। সেই তার প্রথম সাফল্য। যেখান থেকে তিনি এক লাফে শাহরুখ খানের বিপরীতে। ফারহা খানের ছবি ‘ওম শান্তি ওম’ এ। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন নায়িকা। আর পরিচালকের ঘাম ছুটিয়েছিলেন। দীপিকা তখনও অভিনয়ের ‘অ’ জানতেন না। ফলে প্রতি দৃশ্যে তিনি ফারহার কাছে বকুনি খেতেন। তার শোধ তুলতেন সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। একেক সময় এতটাই জ্বালাতেন যে ফারহার মনে হত, ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন দীপিকাকে! পরে তারাই খুব ভালো বন্ধু।
ওই সময়েই প্রেমের পাশাপাশি অভিনয়েও মন দিয়েছেন ‘মস্তানি’। অনুপম খেরের অভিনয় শেখানোর স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ধীরে ধীরে তার অভিনয় ধারালো হয়েছে। তিনি রণবীরের প্রেমে ভেসেছেন। দীপিকার পেলব, মসৃণ গ্রীবায় জ্বলজ্বল করত ভালোবাসার স্বাক্ষর! টুকটুকে ফর্সা ত্বকে কালো আখরে লেখা আর কে! এ নামের মালিক রণবীর কাপুর ছাড়া আবার কে?
দীপিকা তখনও জানতেন না, জীবন তাকে কী দিতে চলেছে? একের পর এক ছবিতে কাজ আর প্রেম। ভেবেছিলেন এমনি করেই বুঝি দিন কাটবে। হঠাৎই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন বলিউডের ‘ক্যাসানোভা’! দীপিকার চোখে সেই প্রথম অন্ধকার নেমেছিল। ছবির খারাপ ব্যবসা, অভিনয় নিয়ে কটূক্তি শুনেও যে মেয়ে ভেঙে পড়েননি সেই মেয়ে এখানে ভেঙে খানখান।
টানা তিন মাস দীপিকা রোজ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আবার গুঁড়িয়ে যান। বলিউড বলে, মানসিক দিক থেকে এতটাই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন যে তাকে নাকি খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতেন প্রকাশ-উজ্জ্বলা। যাতে না পালিয়ে যেতে পারেন, আত্মহত্যা করতে না পারেন দীপিকা। এভাবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত একা ঘরে কাটাতেন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন মা-বাবা। আর আড়ালে চোখের জল ফেলতেন তারা। দীপিকা পরে নিজেই জানিয়েছেন, ওই তিন মাস তিনি যেন অন্ধকার গুহায় বন্দি ছিলেন। যত চেষ্টা করেছেন আলোর মুখোমুখি হওয়ার, অন্ধকার যেন বেশি করে গ্রাস করত তাকে।
বলিউড ভেবেছিল, দীপিকা আর ফিরবেন না। মায়ানগরী ভুলে গিয়েছিল, তিনি খেলোয়াড়ের মেয়ে। জীবন তার কাছে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতোই। তাই প্রতি দিন নিজের ভেঙে যাওয়া টুকরোগুলোকে জড়ো করেছেন। মনের জোরে তাদের জোড়া লাগিয়েছেন। শেষে একদিন উঠে দাঁড়িয়েছেন। সেই দীপিকার চোখের নিচে গাঢ় কালি! খাওয়া-ঘুম বন্ধের জেরে চেহারার জৌলুস উধাও। আবারও জোর করে হেসেছেন। ভালো ভেবেছেন। ভালো থাকার চেষ্টা করেছেন।
সাল ২০১৫। সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘গোলিও কা রাসলীলা: রাম লীলা’য় তিনি লীলা। রণবীর সিংহ রাম। এ ছবিতে দীপিকার অভিনয়ের জোশে থমকে গিয়েছিল তামাম ভারত। বাস্তবের ‘লীলা’ পেয়েছিলেন তার জীবনের ‘রাম’কে। এ ভালোবাসায় মন বসাতে অনেকগুলো বছর সময় লেগেছিল দীপিকার। তিনি ভালোবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। বিশ্বাস হারিয়েছিলেন মানুষের ওপর থেকেও। এত অবিশ্বাস নিয়েও ভুলতে পারতেন না কাপুর পরিবারের ‘লাভার বয়’কে।
সম্ভবত সেই জায়গা থেকেই একই নামের মালিকের হাতে নিজেকে সপে দিয়েছেন এক সময়। কাপুর না হয় সিংহ হলো। রণবীর তো তারই থাকল! এ টানে বিয়ের অনেক বছর পরেও তার মসৃণ গ্রীবা থেকে চুলের আড়াল সরলেই জ্বলতে দেখা যেত আর কে উল্কি!
আর সবার আড়ালে প্রতিশোধের ছুরি শানিয়েছেন। রণবীরের সঙ্গে এক সময় প্রেম ভেঙেছে ক্যাটরিনারও। ক্যাটরিনা আশ্রয় খুঁজেছেন তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট ভিকি কৌশলের কাছে। সম্প্রতি জমকালো বিয়েও সেরেছেন তারা। বিয়ের সন্ধ্যায় যখন সাত পাক ঘোরা সম্পূর্ণ ভিক্যাটের, দীপিকা ইনস্টাগ্রামে ভাগ করে নিয়েছেন নিজের বিয়ের ছবি! যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন তার পেশা এবং প্রেম জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, ‘আমার গ্রাস কেড়েছিলে। তুমিও ভোগ করতে পারলে না!’
অতীতের সেই ভয়, নিরাপত্তাহীনতা আজও তাড়া করে ফেরে দীপিকাকে। ঘরে-বরে থিতু হয়েও নায়িকা মাঝ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন, তার হাতে আর ভালো চরিত্র নেই! তাকে আর কেউ নিত্য নতুন চরিত্রের জন্য ডাকছে না। অভিনয় ছেড়ে গেলে কী নিয়ে বাঁচবেন তিনি? তার যে এখনও অনেকটা পথচলা বাকি। অনেক কিছু দেওয়া বাকি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে।
আমাদের ফেইসবুক Link : ট্রাস্ট নিউজ ২৪