দড়ি লাফ। ইংরেজিতে স্কিপিং রোপ। কি ছেলে, কি মেয়ে—শখের বশে দড়ি নিয়ে লাফানোর এই খেলায় ছেলেবেলায় মাতেননি এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। সবাই শখের বশে দড়ি হাতে নিলেও এক স্বপ্নবাজ ঠিকই এই দড়ির সঙ্গেই ধরেছিলেন বাজি। সেই বাজিতে জিতলেনও! উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের অজপাড়ার ১৮ বছর বয়সী রাসেল ইসলাম এক পায়ে দড়ি লাফ খেলায় মাত করলেন। নিজের নামটি খোদাই করে নিলেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডের পাতায়।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নের সিরাজপাড়া গ্রামের রাসেলের জন্ম দরিদ্র ঘরে। সেই ঘরে ছিল না আলো। দরিদ্রতার অন্ধকারে রোশনাই ফেলতে একাকী বোনেন স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যে বিশ্বজয়ের, কাউকে টের পাওয়ারও সুযোগ দেননি অদম্য তরুণ রাসেল। গত বৃহস্পতিবার ডাকযোগে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষের পাঠানো সনদ দুটি হাতে পেলে বেরিয়ে আসে রাসেলের অজানা গল্প। তাঁর এমন সফলতায় আনন্দে ভাসছে সবাই।
দিনমজুর বাবা বজলুর রহমানের তিন ছেলের মধ্যে রাসেল দ্বিতীয়। পড়ছেন স্থানীয় শিবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষে। চার বছর ধরে দড়ি লাফ অনুশীলন করে আসছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে এই খেলায় স্কুল পর্যায়ে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয়ভাবে চ্যাম্পিয়ন হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন তিনি। স্কিপিং রোপে এক পায়ের ওপর দুটি বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেন রাসেল। পরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ম মেনে দড়ি লাফ খেলায় এক পায়ে ৩০ সেকেন্ডে ১৪৫ বার এবং ১ মিনিটে এক পায়ে ২৫৮ বার ঘোরানোর ভিডিও ফুটেজ পাঠান। যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় চার মাস পর গিনেস বুকে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করে কর্তৃপক্ষ। এর আগে এক পায়ে ৩০ সেকেন্ড স্কিপিং রোপে লাফানোর বিশ্ব রেকর্ড ছিল ১৪৪ বার। আর ১ মিনিটে এক পায়ে লাফানোর বিশ্ব রেকর্ড ছিল ২৫৬ বার। যার দুটিই ভেঙেছেন রাসেল।
রাসেলের ইচ্ছা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে বাংলাদেশের সুনামের দ্যুতি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করতে নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য বাংলাদেশ বলার স্প্রিড ফেডারেশন ও সরকারের সহায়তাও চান তিনি।
রাসেল জানান, বাবার রোজগারে তাঁদের সংসার কোনো রকমে চলে। নিয়মিত অনুশীলনের পর পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন, যা জোগান দেওয়া তাঁর পরিবারের পক্ষে কখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে পারিবারিক অসচ্ছলতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তবে সাফল্যের শিখরে উঠতে গিয়ে স্থানীয় কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার সহযোগিতাও পাননি রাসেল।
রাসেলের বাবা বজলুর রহমান বলেন, ‘আমি গরিব হয়েও ছেলেকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছি। ছেলের জন্য অনেক কষ্ট করে টাকা রোজগার করতাম। আমার শ্রম আর ঘামের টাকা দিয়ে রাসেল তার খেলার সারঞ্জাম কিনত। মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়ে দড়ি লাফ খেলায় অংশ নিত।’
রাসেলের বড় ভাই আরিফ বলেন, ‘এমন প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকা থেকে রাসেল বিশ্বরেকর্ড করবে আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি। আমরা গরিব হওয়ায় তাকে আর্থিক তেমন সহযোগিতা করতে পারিনি। সে নিজে নিজেই এত দূর এগিয়ে গেছে। আশা করি সে আরো ভালো কিছু করবে।’
রাসেলের এমন সফলতার গল্পে বিমোহিত এলাকাবাসীও। প্রতিবেশীরা জানান, ছেলেবেলা থেকেই এই খেলার প্রতি রাসেলের ঝোঁক ছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। সেই সাফল্য অর্জন হয়েছে। তবে জেলায় এমন সাফল্যের পরও স্থানীয় ক্রীড়া সংস্থা রাসেলের পাশে না থাকায় হতাশ সবাই।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড একটি সম্মানজনক ও গৌরবের ব্যাপার। আমি রাসেলকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে তিনি নতুন নতুন রেকর্ড গড়ুন এই কামনা করছি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
আমাদের ফেইসবুক Link : ট্রাস্ট নিউজ ২৪